ভারতে ইসলাম প্রসার

 



বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশে ৫০০ মিলিয়ন মুসলমানের বসবাস। সারা বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার একটি বড় অংশ  এখানে বাস করে। উপমহাদেশে প্রবেশের পর হতেই ইসলাম এই অঞ্চল ও এর অধিবাসীদের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে আসছে। বর্তমানে ভারতে ইসলামের আগমন সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলো তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ভারতে আরব ও পারসিক মুসলমানদের আগ্রাসনের ফলে ভারতে ইসলাম প্রচারিত হওয়ার কথা বলার চেষ্টা করছে। যদিও, এর সাথে সত্যের দুরতম সম্পর্কও নেই।

 

প্রাথমিক যুগের ভারতীয় মুসলমান

রাসূল (সা.) এর জন্মের পূর্ব হতেই ভারতের সাথে আরব বণিকদের যোগাযোগ ছিলো। বাণিজ্যের উদ্দেশে আরবদের ভারতের সাথে নিয়মিতই যোগাযোগ হত। স্বাভাবিকভাবেই, আরবরা যখন ইসলাম গ্রহণ করে, বাণিজ্যের পাশাপাশি তারা  তখন তাদের নতুন বিশ্বাসের বাণী নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতই ভারতে আগমন করে। ৬২৯ ঈসায়ীতে রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশাতেই কেরালায় ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মসজিদটি নির্মিত হয়। প্রথম ভারতীয় মুসলমান চেরামান পেরুমল ভাস্কর রবী ভার্মা এই মসজিদটি নির্মান করেন। আরব মুসলমান ও ভারতীয়দের মধ্যে বাণিজ্যের প্রেক্ষিতে ভারতীয় সমুদ্র তীরবর্তী জনবসতিসমূহে ইসলামের প্রসার ঘটতে থাকে। আরব মুসলমান বণিকদের আগমন এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।  

 

মুহাম্মদ বিন কাসিম

ভারতে প্রথম ব্যাপকহারে ইসলামের সম্প্রসারণ ঘটে উমাইয়া শাসনামলে। ৭১১ ঈসায়ীতে উমাইয়া সাম্রাজ্য তাদের পূর্ব সীমান্তে ১৭ বছর বয়স্ক এক তরুণ সেনাপতিকে প্রেরণ করে। মুহাম্মদ বিন কাসিম নামক এই তরুণ সেনাপতি তার ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে ইরানের মাকরান সীমান্ত দিয়ে সিন্ধুতে প্রবেশ করেন। ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমে সিন্ধু নদীর তীরে অবস্থিত সিন্ধু বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশ।  

মুহাম্মদ বিন কাসিম তার অভিযানকালে খুব স্বল্পই স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতিরোধের শিকার হন। সিন্ধু নদীর তীরবর্তী নিরূন শহরে পৌছার পর শহর নিয়ন্ত্রণকারী বৌদ্ধ ভিক্ষু স্বেচ্ছায় শহরের নিয়ন্ত্রণ মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাতে ছেড়ে দেন। অধিকাংশ শহরই বিনা যুদ্ধে মুসলমানদের অধীনে চলে আসে। অনেকক্ষেত্রে, নির্যাতিত বৌদ্ধ জনগণ হিন্দু শাসকদের বিরুদ্ধে মুসলিম সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে।  

সিন্ধুর অধিকাংশ জনগণ মুসলিম সেনাবাহিনীকে সাহায্য ও সমর্থন করলেও সিন্ধুর তৎকালীন শাসক রাজা দাহির মুসলিম সেনাবাহিনীকে বাধা প্রদানের লক্ষ্যে তার সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করেন। ৭১২ ঈসায়ীতে দুই বাহিনীর মধ্যে একটি চূড়ান্ত সংঘর্ষ হয়। এতে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হয় এবং সিন্ধু সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।  

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সিন্ধুর জনসাধারণকে জোর করে মুসলমান করা হয়নি। মুসলিম বিজয়ের পরও এখানকার সামাজিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। মুহাম্মদ বিন কাসিম তার অধীনে সকল হিন্দু ও বৌদ্ধ অধিবাসীদের নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন। সকল ভিন্ন ধর্মাবলম্বীই তাদের উপাসনালয় রক্ষায় তার কাছ হতে সহযোগিতা পেয়েছিলো। ধর্মীয় সহনশীলতা ও ন্যায়বিচারের কারণে সিন্ধুর বিভিন্ন শহরের অধিবাসীরা তাকে প্রতিরোধের বদলে বরং তার বাহিনীকে অভিবাদন জানিয়েছিলো।  

 

ইসলাম গ্রহণের প্রক্রিয়া  

ভারতে পরবর্তী মুসলিম অভিযানসমূহের প্রকৃতি ছিলো একইরূপ। সুলতান মাহমুদ, সুলতান মুহাম্মদ ঘুরি এবং সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক ভারতীয় সমাজের কোনো প্রকার ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবর্তন ছাড়াই এখানে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রভাবের বিস্তার ঘটান।

ইসলাম-পূর্ব ভারতীয় ‍উপমহাদেশ বর্ণাশ্রম প্রথায় বিভক্ত ছিলো। এখানে ইসলামের প্রসার ধীরে ধীরে ঘটতে থাকে। কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে প্রায়ই তার পুরো বর্ণই একইসাথে ইসলাম গ্রহণ করতো। এর কারণ ছিলো বিবিধ। প্রধানত, ইসলামের প্রচারিত সাম্যের বাণী জাতপ্রথায় নিষ্পেষিত মানুষকে আকর্ষণ করতো। জাতপ্রথায় একজন ব্যক্তি যে বর্ণে  জন্মগ্রহণ করতো, তাকে আজীবন সেই বর্ণের সেই মর্যাদাই বহন করতে হত। তার নিজের উন্নতির কোনো সুযোগই  ছিলোনা। ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে জনগণ বরং জাত-প্রথার কঠোর নিষ্পেষণ হতে মুক্তির উপায় উদ্ভাবন করে।  

ভারতীয় উপমহাদেশে এক সময়কার জনপ্রিয় বৌদ্ধ ধর্ম ইসলামের শাসনাধীনে তার আবেদন হারিয়ে ফেলে। ইসলামের আগমনের পূর্বে বর্ণপ্রথা হতে মুক্তির জন্য মানুষ বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতো। ইসলামের আগমনের পর মানুষ বর্ণপ্রথার নিষ্পেষন হতে বাঁচতে বৌদ্ধ ধর্মের পরিবর্তে বরং ইসলাম গ্রহন করতে শুরু করে। মুসলমানদের দ্বারা ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম বিনাশের অভিযোগ সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা। মুসলিম শাসনের অধীনে বরং বৌদ্ধরা নিরাপদেই বসবাস করে এবং বৌদ্ধদের প্রতি মুসলমানদের বিরূপতার কোনো প্রমাণই ইতিহাসে পাওয়া যায়না।  

মুবাল্লিগ বা ইসলাম প্রচারকদের দ্বারাও ইসলাম ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পরে। ভারতে ইসলাম প্রচারে তাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা মুসলিম শাসকদের দরবার হতে ইসলামকে ভারতের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে দেন।

 

ইসলামের প্রচার কি শক্তির মাধ্যমে?

অনেকেই দাবী করে, ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান বৃহদাকৃতির মুসলিম জনবসতি সহিংসতা ও জোর করে ধর্মান্তরের ফল। কিন্তু এর পক্ষে যেসকল প্রমাণ দাঁড় করানো হয়, তার ঐতিহাসিক কোনো বিশ্বাসযোগ্যতাই নেই।

যদি প্রকৃতই সহিংসতা ও যুদ্ধের মাধ্যমেই ইসলামের বিস্তার ঘটতো, তবে ভারতে মুসলিম শাসনের কেন্দ্রসমূহেই আজকে বরং মুসলমানের সংখ্যা অধিক হত। এর বদলে আমরা দেখি, ভারতীয় উপমহাদেশের একবারে দূরবর্তী দুই প্রান্তে বরং মুসলমানের সংখ্যা বেশী। এছাড়া ভারতের মধ্যকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূমিগুলো হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনবসতি দ্বারা বিচ্ছিন্ন। এটিই ভারতে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচারের প্রমাণ। মুসলমানরা যদি অসহিষ্ণু হত, তবে চারপাশের এই অমুসলিম জনবসতির অস্তিত্বের প্রশ্নই আসতোনা।  

 

উপসংহার

ইসলাম ভারতীয় উপমহাদেশ ও এর ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামকে ভারতে আগ্রাসনকারী এবং ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে বেমানান ধর্ম হিসেবে যে রাজনৈতিক প্রচারণা বর্তমানে চলছে, ইসলামের শান্তিপূর্ণ বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই আমাদের এইসকল উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচারণার মোকাবেলা করতে হবে।

সাততেতৈয়া

শরিয়ত,তরিকত,হাকিকত ও মারফত কাকে বলে? বিস্তারিত?

পবিত্র কুরআন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান।

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-বড় পীর এর জীবনী

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

তাজবীদ

জামে মসজিদ নীতিমালা