প্রথম প্রতিরোধ পুলিশের

প্রথম প্রতিরোধ পুলিশের
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ভোর পৌনে ৫টা কি ৫টা বাজে। হঠাৎ করেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে সাঁজোয়া যানসহ হামলা করে দুষ্কৃতকারীরা। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা হতবিহ্বল কর্মকর্তারা প্রথমে বুঝতেই পারেননি কী হচ্ছে, তাদের ধারণাও ছিল না যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্যই এই হামলা হয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতা কেটে গেলে অবশ্য তারা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা ২৫৯ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। কিন্তু সেনাবাহিনীর সহায়তার আশায় শেখ কামালের নির্দেশে গুলি ছোড়া বন্ধ করে পুলিশ। তবে শেষ পর্যন্ত সেনাসদস্যরা এগিয়ে আসেনি। একে একে প্রাণ হারান জাতির পিতাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। সেই দিন পুলিশের তৎকালীন এসডিপিও (সাবডিবিশনাল পুলিশ অফিসার) নুরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে নয় সদস্যের প্রতিরোধ চেষ্টার তথ্য বর্তমান আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর উদ্যোগে প্রকাশিত একটি অ্যালবামে উঠে এসেছে।
সম্প্রতি দেশ রূপান্তরকে সেই দিনের ঘটনা শুনিয়েছেন এসডিপিও নুরুল ইসলাম খান। তার ভাষ্যে ১৫ আগস্টের ঘটনা
‘১৫ আগস্ট রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ডিউটি ছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। আমি সিকিউরিটি চার্জে ছিলাম। আমাদের সঙ্গে আর্মির লোকও পাহারায় ছিল। ওইদিন ভোর ৫টার সময় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিচতলায় আমাদের রেস্টরুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলামও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। একটি খাটে আমরা বসা ছিলাম। ওই সময় দ্বিতীয় তলায় বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম। বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বলছিলেন কেন আমার বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আসবে? আপনারা কী করেন? আপনারা থাকতে কীভাবে দৃষ্কৃতকারীরা আসবে? তারপর বঙ্গবন্ধু বলেন, আপনারা যা ভালো মনে করেন তাই করেন। পরে তিনি মুহিতকে বললেন, বঙ্গভবনে ফোন লাগা। কিন্তু ফোন লাইন কাটা ছিল। পরে তিনি নিজেই ফোন করার চেষ্টা করলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ, নাইন ডিভিশনের জিওসি এবং বঙ্গভবনের প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) কর্নেল জামিলকে। কিন্তু কাউকে ফোনে পাচ্ছিলেন না। তখন বুঝলাম দৃষ্কৃতকারীরা ফোনের কানেকশন কেটে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, দেখেন তো বাইরে কোনো লোক দেখা যায় কি না। কোথায় থেকে হামলা হচ্ছে। আমি বললাম, স্যার বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। উনিও চেষ্টা করলেন বাইরে কিছু দেখা যায় কি না। তিনি বলতে লাগলেন, এত ফায়ারিং কিসের? তখন আমি বললাম, স্যার, বাইরে থেকে হামলা হয়েছে। আমরা ফায়ারিংয়ের জবাব দিচ্ছি। উনি বললেন, ফায়ারিং চলুক। বঙ্গবন্ধু আবার দ্বিতীয় তলায় চলে গেলেন। যাওয়ার সময় দেখলেন পিএ মুহিতের রুমের সামনে গুলি পড়ছে। তবে মুহিতের শরীরে গুলি লাগেনি।’
নুরুল ইসলাম বলেন, সেদিন বাড়িতে নয়জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছিলাম। বাড়ির মূল গেটের সামনে তিনজন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করে। আমরা সর্বপ্রথম প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলাম। দুষ্কৃতকারীরা যখন গুলি করছিল তখন আমরাও পাল্টা গুলি চালাচ্ছিলাম। পুলিশের তোপের মুখে দুষ্কৃতকারীরা ফায়ারিং বন্ধ রাখে কিছুক্ষণ। তখন আমি সুবেদারকে বললাম, দেখেন তো কয় রাউন্ড গুলি ফায়ার করা হয়েছে। সুবেদার আমাকে জানালেন ২৫৯ রাউন্ড গুলি ফায়ারিং হয়েছে। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল নিচে আসলেন। উনি এসে আমাকে বললেন, দেখেন তো আর্মির কাউকে দেখা যায় কি না। আমি বললাম, আর্মির কাউকে দেখা যায় না। তিনি বললেন, আপানারা (পুলিশ) ফায়ারিং বন্ধ করেন। নিরীহ লোকজন মারা যাবে। আর্মি ভাইয়েরা আমাদের সাহায্যের জন্য আসছেন। তারা আমাদের ছেড়ে যাবেন না।
শেখ কামাল গেটের কাছে গিয়ে বললেন, আর্মি ভাইয়েরা কে কোথায় আছেন? আপনারা গেটের ভেতরে আসেন। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি ভেতরে চলে আসলেন। এই সময় কয়েকজন আর্মির অফিসার বাইরে থেকে এসে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে (সবার হাতে এসএমজি ছিল)। এই সময় শেখ কামাল আমাদের পাশেই ছিলেন। অনগার্ড পজিশনে এসে আর্মির অফিসাররা আমাদের আত্মসমর্পণ (হ্যান্ডসআপ) করতে বলে। আমরা আত্মসমর্পণ করলেও শেখ কামাল আত্মসমর্পণ করেননি। দ্বিতীয়বার আবারও আত্মসমর্পণ করতে বলে। সাত আর্মি অফিসারের মধ্যে চারজন ছিল খাকি পোশাকে। তিনজন কালো ড্রেসে। আর এ সুযোগে একসঙ্গে আর্মির আরও সদস্য ভেতরে প্রবেশ করে। সবাই অস্ত্র ফেলে দিতে বলে। আমরা অস্ত্র ফেলে দিতে বাধ্য হই। অন্তত একশর মতো আর্মির লোক বাইরে থেকে ভেতরে চলে আসে। আমরা তখন নিরুপায় হয়ে পড়ি।
নুরুল ইসলাম বলেন, প্রতিরোধ করতে গিয়ে তখন পুলিশের এক সদস্য মারা যান। আমার এক সুবেদার গুলিবিদ্ধ হন। এই সময় আমাকে বারবার জেরা করে আর্মি অফিসাররা। সাত আর্মি অফিসারের মধ্যে ছয়জন দ্বিতীয় তলায় চলে গেল। আর একজন আমাদের সামনে ছিল। ওই অফিসার আমার সামনে থাকা শেখ কামালের কাছে এসে গুলি করে। মেরে ফেলল। মারা যাওয়ার আগে শেখ কামাল বললেন আমি শেখের ছেলে কামাল।
তখন বঙ্গবন্ধু ওদের বললেন, তোরা আমার কামালকে মেরে ফেলছস? ওরা স্যারের কাছাকাছি একটা রেকর্ডার বাক্স’র মাইক সামনে এগিয়ে দিল; এরপর তারা স্যারকে একটা কাগজে সই করতে বলে। বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে আঙুল উঁচিয়ে স্বভাবসুলভভাবে বলেন, তোমরা জানো পাকিস্তানিদের কাছে আমি মাথানত করিনি। কী হইছে তা বলো? তখন উনাকে তারা একবার দ্বিতীয় আবার নিচতলায় ওঠানামা করায়। এদিকে বাইরে থেকে প্রচন্ড গুলি বাড়ির দিকে আসছে। জানালা ভেদ করে ভেতরেও প্রবেশ করছে। বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশে বললেন, ওদের গুলি বন্ধ করতে বলো। ঠিক তখনই কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই বঙ্গবন্ধুকে তারা বুকের ওপর একের পর এক গুলি করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতেই লুটিয়ে পড়েন। পাশেই ছিলেন বেগম মুজিব, তাকেও তারা গুলি করে। এরপর তারা শেখ কামালের রুমে ঢুকে তার স্ত্রীকে গুলি করে। শেখ জামাল আর্মির ইউনিফর্ম তখন পরছিলেন। পুরোটা পরতে পারেননি। এলোপাতাড়ি গুলি করে জামাল ও তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়। শিশু শেখ রাসেলকেও প্রাণে বাঁচতে দেয়নি তারা।
নিচতলার সবাইকে লাইনে করে দাঁড় করানো হলো (বঙ্গবন্ধু বাড়ির পাশে সুপারি গাছের সামনে)। আমার সঙ্গে এসবির এএসআই সিদ্দিকুর রহমানকে লাইনে দাঁড় করিয়ে বুকে গুলি করল আর্মি অফিসার। গুলি খেয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আর্মিরা বলল সব পুলিশকে মেরে ফেলতে। যাকে পাও তাকেই বের করে গুলি করো। আমি লাইন থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধুর পিএ মুহিতকে রুম থেকে বের করে লাইনে দাঁড় করাই। বাথরুমে আশ্রয় নেন বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের। নাসেরকে বের করে গুলি করল। নাসেরকে রক্তাক্ত অবস্থায় আমার সামনে নিয়ে আসে। আমাকে দেখিয়ে আর্মি অফিসার নাসেরকে বলেÑ উনি কে? উনি এই বাড়ির চার্জে আছেন। তিনি পুলিশের এসডিপিও নুরুল ইসলাম। পরে শেখ নাসেরকে একটি রুমে নিয়ে মেরে ফেলে।
নুরুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের জন্য পুলিশের প্রতিটি সদস্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। আমরা সেভাবেই দুষ্কৃতকারীদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতোই শেখ কামাল ছিলেন উদার। তিনি এসে বললেন, আপনারা গুলি করলে নিরীহ লোকজন মারা যাবে। আপনারা চিন্তা কইরেন না, আর্মি ভাইয়েরা আমাদের সহায়তার জন্য আসছেন। তাদের প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস। আর্মির লোকজন যদি এগিয়ে আসত তাহলে সবাইকে রক্ষা করা সম্ভব হতো। কিন্তু তারা সেটা করেনি। বরং তারা বিরোধিতা করেছে।
হত্যাকা-ের শেষে মেজর ডালিম একটি জিপে করে আসে। একে একে আমাদের পরিচয় জানতে চায়। বিয়ের সময়ের গহনাসহ উপহার পাওয়া সবকিছু লুট করে সেনাসদস্যরা। অফিসাররা আমাদের ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মেজর ডালিম বলতে লাগল আমি ডালিম বলছি। একজনকে ইঙ্গিত করে বললÑ তুমি শেখের গাড়িটি নিয়ে খন্দকার মোশতাকের বাড়িতে যাও। তাকে বলো আপনারে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়েছে।

সাততেতৈয়া

শরিয়ত,তরিকত,হাকিকত ও মারফত কাকে বলে? বিস্তারিত?

পবিত্র কুরআন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান।

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-বড় পীর এর জীবনী

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

তাজবীদ

জামে মসজিদ নীতিমালা