হযরত শাহজালাল (র:) এর অলৌকিক কারামত
হযরত শাহজালাল (র:) এর কিছু অলৌকিক কারামত
নবী-রাসূল
কিংবা অলী-আউলিয়াগণ প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনার
অবতারণা করেছেন, স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব ঘটনা একদমই অলৌকিক।
নবী-রাসূলগণ যখন এ ধরনের ঘটনার অবতারণা করেন, তখন তাকে বলে মুজিযা। একইরকম
ঘটনার অবতারণা যখন কোনো অলী-আউলিয়া করেন, তখন তাকে বলে কারামত। সিলেটের
হযরত শাহজালাল (র:) সম্পর্কেও বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনা প্রচলিত আছে। সেসব ঘটনা
মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এগুলোর মাঝে কিছু কিছু গ্রন্থিত হয়ে বই আকারে
প্রকাশও হয়েছে।
লোকমুখে প্রচলিত ঘটনাগুলো মানুষভেদে অল্পস্বল্প এদিক সেদিক হয়ে যায়। সেজন্য লোকমুখে প্রচলিত কারামতগুলোকে পাশ কাটিয়ে বইয়ে গ্রন্থিত কিছু ঘটনার আলোকপাত করা হবে এ লেখায়। অনেকগুলো ঘটনার মাঝে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো, ধীরে ধীরে বাকিগুলোও উল্লেখ করা হবে।
যখন শুনলেন হযরত শাহজালাল (র:) ইয়েমেনে আসছেন তখন তার ইচ্ছে হলো হযরত শাহজালাল (র:)-এর আধ্যাত্মিকতার গভীরতা কতটুকু তা একটু পরীক্ষা করে দেখবেন। সে উদ্দেশ্যে তিনি হযরত শাহজালাল (র:) এবং তার সাথীদেরকে রাজদরবারের মেহমান হিসেবে আমন্ত্রণ করেন। তারা উপস্থিত হলে তাদেরকে শরবত পরিবেশন করা হয়। হযরত শাহজালাল (র:)-কে পরীক্ষা করার জন্য তিনি শরবতের মাঝে বিষ মিশিয়ে রেখেছিলেন।
লোকমুখে প্রচলিত ঘটনাগুলো মানুষভেদে অল্পস্বল্প এদিক সেদিক হয়ে যায়। সেজন্য লোকমুখে প্রচলিত কারামতগুলোকে পাশ কাটিয়ে বইয়ে গ্রন্থিত কিছু ঘটনার আলোকপাত করা হবে এ লেখায়। অনেকগুলো ঘটনার মাঝে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো, ধীরে ধীরে বাকিগুলোও উল্লেখ করা হবে।
বিষ যখন শরবত
হযরত শাহজালাল (র:)-এর জন্মস্থান ইয়েমেন। জন্মস্থান ছেড়ে ভারতবর্ষ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করছেন এমন সময়ে জন্মভূমির কাছে যাবার খুব ইচ্ছে হলো। সেখানে গেলে বাবা-মায়ের কবরও জিয়ারত করতে পারবেন। উল্লেখ্য, হযরত শাহজালালের (র:) জন্মের আগেই তার পিতা মারা যান এবং জন্মের কয়েক মাসের মাথায় তার মাতাও মারা যান। জন্মভূমিতে যাবার লক্ষ্যে ১২ জন সাথী নিয়ে ইয়েমেনের দিকে রওনা হন তিনি। সে সময় ইয়েমেনের বাদশাহ ছিলেন সুলতান ওমর আশরাফ। ততদিনে হযরত শাহজালাল (র:)-এর জ্ঞান-গরিমা, আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিকতার খবর সারা বিশ্ব বিদিত। ইয়েমেনের বাদশাহও তার ব্যাপারে শুনেছিলেন।যখন শুনলেন হযরত শাহজালাল (র:) ইয়েমেনে আসছেন তখন তার ইচ্ছে হলো হযরত শাহজালাল (র:)-এর আধ্যাত্মিকতার গভীরতা কতটুকু তা একটু পরীক্ষা করে দেখবেন। সে উদ্দেশ্যে তিনি হযরত শাহজালাল (র:) এবং তার সাথীদেরকে রাজদরবারের মেহমান হিসেবে আমন্ত্রণ করেন। তারা উপস্থিত হলে তাদেরকে শরবত পরিবেশন করা হয়। হযরত শাহজালাল (র:)-কে পরীক্ষা করার জন্য তিনি শরবতের মাঝে বিষ মিশিয়ে রেখেছিলেন।

ইসলামের নিয়ম অনুসারে, খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে হয় এবং এই বাক্যের অনেক অলৌকিক গুণ আছে। তারা সকলে বিসমিল্লাহ বলে সেই শরবত পান করলেন এবং সকলেই নিরাপদ রইলেন। উপরন্তু বিষহীন সাধারণ শরবত পান করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন বাদশাহ। খোদার লীলাখেলা বোঝা বড়ই কঠিন। বিষ হয়ে যায় শরবত আর শরবত হয়ে যায় বিষ। এ ঘটনা দেখে ভীত হয়ে বাদশাহর পুত্র সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে হযরত শাহজালাল (র:)-এর সাথে সাথী হয়ে চলে আসেন।
দরগাহের পুকুরের সাথে যমযম কূপের সংযোগ
সিলেট নগরটি গড়ে উঠেছে সুরমা নদীকে কেন্দ্র করে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এ নদীর পানি বেশিরভাগ সময়ই ঘোলা থাকে। যারা সিলেটের সুরমা নদীর কাছে গিয়েছেন, তারা দেখে থাকবেন এর পানি কেমন হলদেটে। পাহাড়ি হলদেটে মাটির কণা এর মাঝে ভাসমান থাকে বলে এটি ঘোলা থাকে। নদীর ধারায় যখন স্রোত থাকে তখন পানির কণা তার সাথে করে কিছু মাটির কণাকেও নিয়ে যেতে পারে। পানি যখন স্থির হয়ে যায় তখন পানির কণার পক্ষে পলির কণা বহন করা সম্ভব হয় না, ফলে পলির কণা নীচের পড়ে যায়। সুরমা নদীতে বেশিরভাগ সময়ই স্রোত বিদ্যমান থাকে।
সুরমা নদীর পানি বেশিরভাগ সময়ই ঘোলা থাকে; ছবি: আরিফুর রহমান

পুরাতন ছবিতে মক্কার যমযমের কূপ; ছবি: মুসলিম গ্রুপস
হযরত শাহজালাল (র:) আল্লাহর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন এর সাথে যেন মক্কার যমযম কূপের সংযোগ স্থাপিত হয়, হলোও তা। এর পানি যমযমের মতোই স্বচ্ছ এবং সুস্বাদু। লাঠির আঘাতে সিলেটের কূপের সাথে মিলন ঘটে সুদূর মক্কার যমযম কূপের।
পরবর্তীতে একসময় ঐ কূপটির চারপাশ পাকা করে দেয়া হয়। একদিকে দুটি পাথর বসিয়ে দেয়া হয় যা থেকে সবসময় পানি প্রবাহিত হয়। পানীয় হিসেবে পান করার গণ্ডি ছাড়িয়ে এটি এখন অনেক কাজে ব্যবহার করা হয়। হযরত শাহজালাল (র:)-এর ভক্তদের বিশ্বাস, এই কূপের পানি পান করলে অনেক রোগ ভালো হয়ে যায়। এমনও প্রচলিত আছে, অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও ভালো হয়নি এমন দুরারোগ্য ব্যাধীও সেরেছে এখানের অলৌকিক পানি পান করার পর। দরগাহে অনেকে নিয়মিত থাকেন, তাদের অনেকে রোজা রাখেন। সেসব রোজাদারেরা এখানের পানি পান করে ইফতার করেন।

দরগাহের সেই কূপ; ছবি: মরুভূমির জলদস্যু’র ব্লগ থেকে
দরগাহের পুকুরে বাটিভর্তি স্বর্ণমুদ্রা
তৎকালে লেনদেনের জন্য স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল। আর সে সময় এখনকার মতো আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। কেউ হজ্ব করতে গেলে মাসের পর মাস পায়ে হেঁটে যেতে হতো। এতে অনেকদিন সময় তো লাগতোই, পাশাপাশি পথে পথে ওৎ পেতে থাকতো চোর-ডাকাত আর বিপদ-আপদ। সিলেটের চান্দাইটিলা গ্রামে আব্দুল মনসুর ও আব্দুল ওহাব নামে দুজন ব্যক্তি বসবাস করতেন। তারা একবার হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করলেন। ঠিকমতো হজ্ব সম্পন্নও করলেন। যখন ফিরে আসার সময় হলো, তখন তারা দেখতে পেলেন তাদের কাছে বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা অবশিষ্ট রয়েছে। ফিরে আসতে হলে এত পরিমাণ মুদ্রার প্রয়োজন পড়বে না। তাই এগুলো নিয়ে তাদের মাঝে বেশ চিন্তার জন্ম হলো। পায়ে হেঁটে কিংবা উটে চড়ে আসতে হবে এতটা রাস্তা, পদে পদে আছে ডাকাতের উৎপাত, মুদ্রাগুলো যেকোনো সময় ছিনতাই হয়ে যেতে পারে।এমন পরিস্থিতিতে তারা চমৎকার একটি বিষয় সম্বন্ধে ভাবলেন। হযরত শাহজালাল (র:)-এর মাজারের পাশে একটি পুকুর আছে। হযরত শাহজালাল (র:)-এর ভক্তদের মাঝে প্রচলিত আছে যে, এখানের পুকুরের সাথে যমযম কূপের সংযোগ বিদ্যমান। এখানের পানি পান করা মানে যমযম কূপের পানি পান করা। এই বিশ্বাস থেকে দুজন ভাবলেন, যমযম কূপে যদি স্বর্ণমুদ্রাগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে সেগুলো নিশ্চয় হযরত শাহজালাল (র:)-এর মাজারের পুকুরে গিয়ে উপস্থিত হবে। যদি এই পদ্ধতিতে মুদ্রাগুলোকে বাসস্থান সিলেটে পাঠানো যায় তাহলে নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে পাড়ি দেয়া যাবে বিপদসঙ্কুল পথ।
চমকপ্রদ এই ভাবনায় দুজন সম্মত হয়ে যাত্রাপথের জন্য অল্প কিছু স্বর্ণমুদ্রা রেখে বাকিগুলোকে একটি বাটিতে প্যাকেট করে ছেড়ে দেন যমযম কূপে। মুদ্রার সাথে নিজেদের নাম ঠিকানাও লিখে দেন। আল্লাহর নামে সেগুলোকে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে পথ পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হন বাসভূমি সিলেটে। মক্কা নগরী থেকে সিলেটে পৌঁছাতে তাদের দুই মাস সময় লেগে যায়। তবে তাদের পৌঁছানোর আগেই হযরত শাহজালাল (র:)-এর দরগাহে পৌঁছে যায় তাদের সেই স্বর্ণমুদ্রার বাটি। দরগাহের খাদেম একদিন পুকুর পরিষ্কার করতে এসে এই বাটিটি পান। এটি খুলে দেখেন এর ভেতরে সিলেটের একটি ঠিকানা এবং বেশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা। নিশ্চয় কোনো অলৌকিক কিছু হয়ে থাকবে মনে করে তিনি বাটিটি যত্ন সহকারে রেখে দেন।

ছবি: iStock

মক্কা থেকে সিলেট। ছবি: গুগল ম্যাপ
জ্বলন্ত আগুন যখন সুস্বাদু খাদ্য
হযরত শাহজালাল (র:) যখন নিজ দেশ থেকে সিলেটে আগমন করেন, তখন যাত্রাকালে কিছুদিন ভারতের দিল্লিতে অবস্থান করেন। সে সময় ঐ অঞ্চলে বাস করতেন হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (র:)। তিনিও একজন জগদ্বিখ্যাত পীর। সেখানে তার অনেক ভক্ত ছিল। হযরত শাহজালাল (র:) তার আস্তানায় আসা যাওয়া করতে লাগলেন। একদিন এক ভক্ত হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া (র:)-এর কাছে গিয়ে বললেন তাদের আস্তানায় একজন লোক এসেছেন। এ লোকের আধ্যাত্মিক শক্তি বেশ প্রবল এবং তার সংস্পর্শে আসলে দিল ঠাণ্ডা হয়ে যায়, মনের দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়। অজানা জিনিসের ব্যাপারে তিনি না দেখেই বলে দিতে পারেন।
হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার দরগাহ। ছবি: ম্যাপস অব ইন্ডিয়া

হযরত শাহজালাল (র:)-এর দরগাহে জালালী কবুতর; ছবি: Kykinrooms