সেকালের নবাব একালের বংশধর
সেকালের নবাব একালের বংশধর
অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীর দীর্ঘ সময় জুড়ে ভারতের তিন নবাব ও সুলতানের নাম তৎকালীন কলকাতা ও বাংলার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল৷
ইতিহাসের
কিছু সন্ধিক্ষণের কথিত সেই খলনায়ক বা নায়ক হিসাবে পরিচিত মীরজাফর, বা টিপু
সুলতান ও ওয়াজেদ আলি শাহর বংশধররা আজও কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ শহরে ছড়িয়ে
আছেন৷ কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে কেমন আছেন তাঁরা- তারই সন্ধানে
সেকালের নবাব একালের বংশধর’- ছয় পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে
মীরজাফরের বংশধরদের কথা৻
১৯৪৭ সালে ভারতে ইংরেজ
শাসনের অবসান হলে একটি স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে বহু
নবাব পরিবারেই বংশধরদের নামের আগে নবাব উপাধি ঝরে পড়তে থাকে৷ আর সেই
পরিবর্ত‡নর হাওয়ায় তাঁদের জীবনের চালচিত্রও বদলাতে থাকে৻
মীরজাফরের
এক বংশধর, ড: সৈয়দ মহম্মদ রেজা আলি খান, এ প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘‘আমি শিক্ষক
ছিলাম৷ আমার পরিবারে প্রথম আমি চাকরিতে এসেছি৷ আমার বাবাও নবাব হিসাবে
পেনশন পেতেন মাসে আটশ টাকা৷ জমি, বাগান সবই ছিল৷ কিন্তু যুগ বদলে গেছে৷
জমিদারি শেষ হওয়ার পর এখন আয়ের থেকে ব্যয় বেশী৷ যাদের পরিবার ভেঙে বড় হয়ে
গেছে তাদের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় শিক্ষাও পাচ্ছে না৷ কেউ রিক্সাও
টানছে৷ চায়ের দোকানও করেছে৷‘‘
ড:
খানের মত আর এক বংশধর সৈয়দ শানদার আলি মির্জা স্কুলে শিক্ষকতা করেন৷
মুর্শিদাবাদ শহরে ভাগীরথীর তীরে হাজারদুয়ারী প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের
কিছু খারাপ লাগার কথা বলছিলেন তিনি: ‘‘কষ্ট হয় যে একসময় আমাদের অক্সফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ারও কোটা ছিল৷ সে সবই এখন শেষ হয়ে গেছে৷ আগেকার অনেক
সুযোগ সুবিধাই আমরা আর পাইনি৻ ... যারা লেখা-পড়ার সুযোগ পায়নি তারা সরকারী
কাজও কিছু জোটাতে পারে নি৻‘‘
ড: রেজা আলি খানও
মনে করেন এ ব্যাপারে নবাবের বংশধররা বঞ্চিত হচ্ছেন৷ তিনি বললেন, ‘‘খুব দু:খ
লাগল যে ভারত সরকার যখন হাজারদুয়ারী প্রাসাদটি অধিগ্রহণ করল সেখানে বাইরের
লোক অনেকে চাকরী পেলেও আমাদের নবাব পরিবারের যারা শিক্ষিত ছিল, তারা কেউ
চাকরী পায়নি৷ আমাদের পরিবারের শিক্ষিত বেকার ছেলেরা তো আর চুরি ডাকাতি করতে
পারবে না, সরকার তো কিছু করতে পারত৷‘‘
মীরজাফরের
বহু বংশধরেরই আর্থিক অবস্থা এখন শোচনীয়৷ সেরকমই একজন, শাকিল মির্জা, যিনি
কোনক্রমে জীবনটাকে টেনে নিয়ে চলেছেন: ``আগে তো ব্যবসা কিছু ছিল, এখন সে সব
শেষ হয়ে গেছে৷ এখন ওই টিউশনি করি কোরাণ পাঠের৷ আর মজলিস পড়ি স্টেটের, তাতে
মাত্র সাড়ে সাতশ’ পাই- ব্যস্ ... কি বলব দু:খের কথা ... আর্থিক অবস্থা
খারাপ হওয়ায় বুদ্ধি হারা পর্যন্ত হয়ে যায়, সব কিছু খারাপ হয়ে যায়৷‘‘
কিন্তু
আর্থিক অবস্থা যাই হোক, তরুণ প্রজেন্মর বেশীরভাগই যে আজ নিজেদের অতীতটা
ভুলে যাচ্ছে- ড: রেজা আলি খানের কথায় সে দু:খ ঝরে পড়ল৷ তিনি বলেন, এই
পরিবারেই একজন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন৷ তাঁর নাম ইস্কান্দার
মির্জা৻
নবাব
পরিবারের বংশধরদের যে একটা পরিচিতি আছে, সেটা রক্ষা করতে হবে৷ কিন্তু তরুণ
প্রজন্ম এসব ব্যাপারে অনাগ্রহী; তারা নিজেদের অতীত ভুলে যাচ্ছে৷ ‘‘এতে
সামনে পা ফেলতে ওদেরই অসুবিধা হবে, তাই দু:খ হয়,‘‘ তিনি বলেন৻
তবে
নবাবি আমলের কীর্তিগুলি দেখতে দেখতে আবেগে আপ্লুত হচ্ছিলেন শানদার আলি
মির্জা৻ তিনি বললেন, ‘‘আমরা যে প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেটা আমাদের
চতুর্থ পুরুষ তৈরী করে ছিলেন৷ আমি সেই পরিবারের ছেলে বলে আমার খুব গর্ব হয়৷
তবে এখন আমি একজন ভারতীয় নাগরিক৻ সবার যেমন অধিকার আমারও তেমনি অধিকার৷‘‘
নিজেদের পরিবারের ইতিহাস অনুসন্ধানের কাজ যিনি
এখনো অব্যাহত রেখেছেন, সেই রেজা আলি খানের ক্ষোভ- মুর্শিদাবাদের নবাবদের
যেন ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে: ``যে মুর্শিদাবাদ থেকে একসময়ে বাংলা,
বিহার, ওড়িশা শাসন করা হয়েছে, যে মুর্শিদাবাদ বললেই নবাবদের কথা মনে হয়-
সেই মুর্শিদাবাদকে এখন লালবাগ- লালবাগ বলে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে৻‘‘