ইতিকাফের উপকারিতা


১. ইতিকাফকারী এক নামাযের পর আর এক নামাযের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আর এ অপেক্ষার অনেক ফজিলত রয়েছে। আবু হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃ
অর্থাৎ নিশ্চয় ফিরিশতারা তোমাদের একজনের জন্য দু'আ করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাযের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাযের স্থানে থাকবে, ও নামায তাকে আটকিয়ে রাখবে, তার পরিবারের নিকট যেতে নামায ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফিরিশতারা তার জন্য এভাবে দু'আ করতে থাকবে।
২. ইতিকাফকারী কদরের রাতের সন্ধানে থাকে, যে রাত অনির্দিষ্টভাবে রমজানের যে কোন রাত হতে পারে। এই রহস্যের কারণে আল্লাহ তা'আলা সেটিকে বান্দাদের থেকে গোপন রেখেছেন, যেন তারা মাসজুড়ে তাকে সন্ধান করতে থাকে।
৩. ইতিকাফের ফলে আল্লাহ তা'আলার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়, এবং আল্লাহ তা'আলার জন্য মস্তক অবনত করার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। কেননা আল্লাহ তা'আলা বলেন ঃ
‘‘আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি’’। [সূরা আয-যারিয়াত ঃ ৫৬] আর এ ইবাদতের বিবিধ প্রতিফলন ঘটে ইতিকাফ অবস্থায়। কেননা ইতিকাফ অবস্থায় একজন মানুষ নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ইবাদতের সীমানায় বেঁধে নেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির কামনায় ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আল্লাহ তা'আলাও তাঁর বান্দাদেরকে নিরাশ করেন না, বরং তিনি বান্দাদেরকে নিরাশ হতে নিষেধ করে দিয়ে বলেছেন ‘‘বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুণাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’’। [সূরা যুমার ঃ ৫৩]। ‘‘আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করি যখন সে প্রার্থনা করে। কাজেই তারা যেন আমার হুকুম মান্য করে এবং আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। সম্ভবত তারা পথ প্রাপ্ত হবে’’। (সূরা আল-বাকারা ঃ ১৮৬)
৪. যখন কেউ মসজিদে অবস্থান করা পছন্দ করতে থাকে যা সম্ভব প্রবৃত্তিকে অভ্যস্ত করানোর মাধ্যমে, কেননা প্রবৃত্তিকে যে বিষয়ে অভ্যস্ত করানো হবে সে বিষয়েই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। মসজিদে অবস্থান করা পছন্দ হতে শুরু করলে মসজিদকে সে ভালোবাসবে, সেখানে নামায আদায়কে ভালোবাসবে। আর এ প্রক্রিয়ায় আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক মজবুত হবে। হৃদয়ে সৃষ্টি হবে নামাযের প্রতি ভালোবাসা এবং নামায আদায়ের মাধ্যমেই অনুভব করতে শুরু করবে হৃদয়ের প্রশান্তি। যে প্রশান্তির কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে বলেছিলেন, অর্থাৎ নামাযের মাধ্যমে আমাদেরকে শান্ত করো হে বেলাল, নামাযের মাধ্যমে আমাদেরকে শান্ত করো হে বেলাল।
৫. মসজিদে ইতিকাফের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ তা'আলার উদ্দেশে নিজেকে আবদ্ধ করে নেয়ার কারণে মুসলিমদের অন্তরের কঠোরতা দূরীভূত হয়, কেননা কঠোরতা সৃষ্টি হয় দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও পার্থিবতায় নিজেকে আরোপিত করে রাখার কারণে। মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখার কারণে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসায় ছেদ পড়ে এবং আত্মিক উন্নতির অভিজ্ঞতা অনুভূত হয়। মসজিদে ইতিকাফ করার কারণে ফিরিশতারা দু'আ করতে থাকে, ফলে ইতিকাফকারী ব্যক্তির আত্মা ফিরিশতাদের স্তরের দিকে ধাবিত হয়। ফিরিশতাদের পর্যায় থেকেও বরং ঊর্ধ্বে উঠার প্রয়াস পায়। কেননা ফিরিশতাদের প্রবৃত্তি নেই বিধায় প্রবৃত্তির ফাঁদে তারা পড়ে না। আর মানুষের প্রবৃত্তি থাকাসত্তেওব সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর জন্য একাগ্রচিত্ত হয়ে যায়।
৬. ইতিকাফের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে। অন্যকে ভালবাসা এবং ক্ষমা করে দেয়ার মন মানসিকতা বৃদ্ধি পায়।
৭. অর্থ বুঝে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত ও তাফসীর পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৮. ঐকান্তিকভাবে আত্মসমালোচনা ও তওবা করার সুযোগ লাভ হয়।
৯. ইসলামি সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিস্তারিত জীবনী, সাহাবাদের জীবনী, ইসলামি আকীদা, শিরক-বিদআত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায ইত্যাদির উপর পড়াশোনা করে সঠিক ইসলামের দেখা পাওয়া যায়।
১০. তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়া যায়।
১১. দশ দিন দশ রাতে ২৪ ঘন্টার রুটিন করে পুরো সময়টাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়।
ইতিকাফের উদ্দেশ্য : আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা : আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হওয়া, আল্লাহ কেন্দ্রিক ব্যতিব্যস্ততা, অন্তর সংশোধন, ঈমানী দৃঢ়তা অর্জন। ইতিকাফ হল এমন একটি ইবাদত যার মাধ্যমে বান্দা সমস্ত সৃষ্টি-জীব থেকে আলাদা হয়ে যথাসম্ভব প্রভুর সান্নিধ্যে চলে আসে। বান্দার কাজ হল তাঁকে স্মরণ করা, তাঁকে ভালোবাসা ও তাঁর ইবাদত করা। সর্বদা তার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা, এরই মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক দৃঢ় ও মজবুত হয়।
পাশবিক প্রবণতা এবং অহেতুক কাজ থেকে দূরে থাকা : রোযার মাধ্যমে আল্লাহ তা-আলা তাঁর বান্দাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন অতিরিক্ত পানাহার ও যৌনাচারসহ পশু প্রবৃত্তির বিবিধ প্রয়োগ থেকে। অনুরূপভাবে তিনি ইতিকাফের বিধানের মাধ্যমে তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন অহেতুক কথা-বার্তা, মন্দ সংস্পর্শ ও অধিক ঘুম হতে। ইতিকাফের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ অর্থে আল্লাহর জন্য নিবেদিত হয়ে যায়। নামায, কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন অর্থসহ অধ্যয়ন, তাফসীর অধ্যয়ন, জিকির ও দু'আ ইত্যাদির চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের অফুরন্ত সুযোগে সে নিজেকে পেয়ে যায়।
শবে কদর সন্ধান করা : ইতিকাফের মাধ্যমে শবে কদর খোঁজ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মূল উদ্দেশ্য ছিল, আবু সায়ীদ খুদরি রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস সে কথারই প্রমাণ বহন করে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘‘আমি প্রথম দশকে ইতিকাফ করেছি এই (কদর) রজনী খোঁজ করার উদ্দেশে, অতঃপর ইতিকাফ করেছি মাঝের দশকে, অতঃপর মাঝ-দশক পেরিয়ে এলাম, তারপর আমাকে বলা হল, (কদর) তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ ইতিকাফ করতে চায় সে যেন ইতিকাফ করে, অতঃপর লোকেরা তাঁর সাথে ইতিকাফ করল’’। [সহীহ মুসলিম]
মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলা : ইতিকাফের মাধ্যমে বান্দার অন্তর মসজিদের সাথে জুড়ে যায়, মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। হাদীস অনুযায়ী যে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিজের ছায়ার নীচে ছায়া দান করবেন তাদের মধ্যে একজন হলেন ওই ব্যক্তি মসজিদের সাথে যার হৃদয় ছিল বাঁধা।
দুনিয়া ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দুরে থাকাঃ ইতিকাফকারী পূর্বে যেসব খারাপ কাজ করত সেসব থেকে সরে এসে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ করে ফেলে। ইতিকাফ অবস্থায় দুনিয়া ও দুনিয়ার স্বাদ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা দ্বীন ইসলাম নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে এবং পরবর্তী জীবনে তা কাজে লাগাতে পারে। ইচ্ছাশক্তি প্রবল করা এবং প্রবৃত্তিকে খারাপ অভ্যাস ও কামনা বাসনা থেকে বিরত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা কেননা ইতিকাফ দ্বারা খারাপ অভ্যাস থেকে বিরত থাকার ট্রেন্ড গড়ে উঠে। ইতিকাফ তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় নিজেকে ধৈর্য্যের গুণে গুণান্বিত করতে ও নিজের ইচ্ছাশক্তিকে শানিত করতে। ইতিকাফ থেকে একজন মানুষ সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে বের হয়ে আসার সুযোগ পায়। যা পরকালে উপকারে আসবে না তা থেকে বিরত থাকার সুযোগ মেলে।
ইতিকাফের নিয়মাবলী : ইতিকাফের সময়-সীমা : সবচেয়ে কম সময়ের ইতিকাফ হল, শুদ্ধ মতানুযায়ী, একদিন একরাত। কেননা সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুম নামায অথবা উপদেশ শ্রবণ করার অপেক্ষায় বা জ্ঞান অর্জন ইত্যাদির জন্য মসজিদে বসতেন, তবে তারা এ সবের জন্য ইতিকাফের নিয়্যত করেছেন বলে শোনা যায়নি। সর্বোচ্চ কতদিনের জন্য ইতিকাফ করা যায় এ ব্যাপারে ওলামাদের মতামত হল, এ ব্যাপারে নির্ধারিত কোন সীমা-রেখা নেই।
ইতিকাফে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার সময় : ইতিকাফকারী যদি রমাদানের শেষ দশকে ইতিকাফের নিয়ত করেন তা হলে একুশতম রাত্রির সূর্যাস্ত যাওয়ার পূর্বে মসজিদে প্রবেশ করবেন, কেননা তার উদ্দেশ্য কদরের রাতের সন্ধান করা, যা আশা করা হয়ে থাকে বেজোড় রাত্রগুলোতে, যার মধ্যে একুশের রাতও রয়েছে। তবে ইতিকাফ থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে উত্তম হল চাঁদ রাত্রি মসজিদে অবস্থান করে পরদিন সকালে সরাসরি ঈদগাহে চলে যাওয়া। তবে চাঁদ রাতে সূর্যাস্তের পর মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলেও কোন সমস্যা নেই, বৈধ রয়েছে।
ইতিকাফের শর্তাবলি : ইতিকাফের নিয়্যত করতে হবে, কেননা মসজিদে অবস্থান হয়তো ইতিকাফের নিয়্যতে হবে অথবা অন্য কোনো নিয়্যতে। আর এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য করার জন্য নিয়্যতের প্রয়োজন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘‘ইতিকাফ মসজিদে হতে হবে এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত তবে জামে মসজিদ হলে উত্তম কেননা এমতাবস্থায় জুমার নামাযের জন্য ইতিকাফকারীকে মসজিদ থেকে বের হতে হবে না’’।

সাততেতৈয়া

শরিয়ত,তরিকত,হাকিকত ও মারফত কাকে বলে? বিস্তারিত?

পবিত্র কুরআন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান।

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-বড় পীর এর জীবনী

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

তাজবীদ

জামে মসজিদ নীতিমালা