শত বছরের পুরান পুতি সাহিত্য

পুথি সাহিত্য


পুথি সাহিত্য আরবি, উর্দু, ফারসি ও হিন্দি ভাষার মিশ্রণে রচিত এক বিশেষ শ্রেণীর বাংলা সাহিত্য। আঠারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত এর ব্যাপ্তিকাল। এ সাহিত্যের রচয়িতা এবং পাঠক উভয়ই ছিল মুসলমান সম্প্রদায়।
পুথি (বা পুঁথি) শব্দের উৎপত্তি ‘পুস্তিকা’ শব্দ থেকে। এ অর্থে পুথি শব্দদ্বারা যেকোনো গ্রন্থকে বোঝালেও পুথি সাহিত্যের ক্ষেত্রে তা বিশেষ অর্থ বহন করে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশেষ সময়ে রচিত বিশেষ ধরণের সাহিত্যই পুথি সাহিত্য নামে পরিচিত। হুগলির বালিয়া-হাফেজপুরের কবি ফকির গরীবুল্লাহ (আনু. ১৬৮০-১৭৭০)  আমীর হামজা রচনা করে এ কাব্যধারার সূত্রপাত করেন। আরবদেশের ইতিহাস-পুরাণ মিশ্রিত কাহিনী অবলম্বনে রচিত আমীর হামজা  জঙ্গনামা বা যুদ্ধ বিষয়ক  কাব্য। মধ্যযুগে প্রায় পাঁচশ বছর ধরে বাংলা ভাষার যে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল, তার সঙ্গে এ কাব্যের ভাষার মিল নেই। বাংলা শব্দের সঙ্গে আরবি, ফারসি প্রভৃতি শব্দের মিশ্রণজাত একটি ভিন্ন ভাষায় কাব্যটি রচিত।  সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এ কাব্যে ৩২% বিদেশি শব্দের পরিসংখ্যান দিয়েছেন। হুগলি, হাওড়া,  কলকাতা, ২৪ পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলমানদের কথ্যভাষা এর উৎস ছিল বলে মনে করা হয়। গরীবুল্লাহ নিজে এবং তাঁর শিষ্য  সৈয়দ হামজা এ ভাষায় আরও কয়েকখানি কাব্য রচনা করেন। তাঁদের অনুসরণে পরবর্তীকালে বহু সংখ্যক মুসলমান কবি এ জাতীয় কাব্য রচনা করেন। এগুলির পাঠক ছিল সর্বস্তরের মুসলমান; তবে নিম্নবিত্তের চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবী মানুষের কাছে এর জনপ্রিয়তা ছিল সর্বাধিক।
পুথি সাহিত্যের শব্দসম্ভার ও ভাষারীতি লক্ষ করে বিভিন্ন জন এর বিভিন্ন নামকরণ করেছেন। রেভারেন্ড জেমস  লং এ ভাষাকে বলেছেন ‘মুসলমানী বাংলা’, আর এ ভাষায় রচিত সাহিত্যকে বলেছেন ‘মুসলমানী বাংলা সাহিত্য’। কলকাতার বটতলার ছাপাখানার বদৌলতে প্রচার লাভ করে বলে এগুলি ‘বটতলার পুথি’ নামেও পরিচিত হয়। গবেষকগণ ভাষা-বৈশিষ্ট্য ও বাক্যরীতির দিক থেকে বিচার করে প্রথমে এগুলিকে দোভাষী পুথি এবং পরবর্তীকালে ‘মিশ্র ভাষারীতির কাব্য’ বলে অভিহিত করেন।
দোভাষী পুথিকারদের সাধারণভাবে ‘শায়ের’ বলা হয়। ‘শায়ের’ আরবি শব্দ, অর্থ কবি। সৈয়দ হামজা আমীর হামজা গ্রন্থের শুরুতে ‘শায়েরি পুঁথি’ বলে স্বীয় কাব্যের পরিচয় দিয়েছেন। এদিক থেকে নামকরণের জটিলতা এড়ানোর জন্য ‘শায়েরি পুঁথি’ অভিধাটি গ্রহণ করা যায়। সাধারণ বাংলা গ্রন্থের মতো পুথি সাহিত্য বাম দিক থেকে পড়া হলেও তা ছাপা হতো আরবি-ফারসির মতো ডান দিক থেকে। পয়ার-ত্রিপদী ছন্দে রচিত অলঙ্কারবর্জিত গদ্যধর্মী সরল ভাষা এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
গরীবুল্লাহর প্রথম কাব্য  ইউসুফ-জুলেখা সাধু বাংলায় রচিত। তিনি মিশ্র ভাষারীতিতে রচনা করেন সোনাভান, সত্যপীরের পুথি, জঙ্গনামা ও আমীর হামজা। আমীর হামজা সম্ভবত তাঁর পরিণত বয়সের রচনা, কারণ তিনি কাব্যখানি শেষ করেননি, সৈয়দ হামজা অসমাপ্ত অংশ সমাপ্ত করেন ১৭৯৫ সালে। সৈয়দ হামজার প্রথম কাব্য মধুমালতী সাধু বাংলায় রচিত। এরপর তিনি মিশ্র ভাষায় রচনা করেন  জৈগুনের পুথি (১৭৯৮) ও হাতেম তাই (১৮০৪) কাব্যদুটি। এসব কাব্যে যে শব্দসম্ভার ও ভাষারীতিকে পুথি সাহিত্যের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে, তা একেবারে অভিনব ছিল না। আগের শতাব্দীগুলিতে কোনো কোনো আখ্যানকাব্যে অনুরূপ ভাষার প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। ২৪ পরগনার কবি  বিপ্রদাস পিপিলাই মনসাবিজয় (১৪৯৫), বর্ধমানের কবি  মুকুন্দরাম চক্রবর্তী চন্ডীমঙ্গল (১৫৯৮), কলকাতার কবি কৃষ্ণরাম দাস  রায়মঙ্গল (১৬৮৬), ভুরশুট পরগনার কবি  ভারতচন্দ্র রায় অন্নদামঙ্গল (১৭৫২) কাব্যে যেখানে মুসলিম প্রসঙ্গ এসেছে সেখানে আরবি-ফারসি শব্দ, এমনকি উর্দু-হিন্দির বাক্রীতিও ব্যবহার করেছেন। তাঁরা সবাই হিন্দু কবি ছিলেন। তুর্কি বিজয়ের পর ফারসি রাজভাষা হিসেবে গৃহীত হলে রাজকার্যে সুবিধা লাভের জন্য হিন্দু, মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ওই ভাষা শিখেছে। মুসলমানরা আরবি ভাষাও শিখেছে। ফলে বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ প্রবেশ করে।
ষোলো শতকে মুগল আমলে দিল্লির সঙ্গে বাংলার প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগসূত্র স্থাপিত হলে এ দেশে মুসলমানদের আগমন বৃদ্ধি পায়। রাষ্ট্র, ধর্ম ও শিক্ষা কার্যে উর্দুভাষী মুসলিম পরিবারগুলি মুর্শিদাবাদ, হুগলি, হাওড়া প্রভৃতি প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রে বসবাস গড়ে তোলে। ফলে ওই সময় বাংলা ভাষায় উর্দু-হিন্দির ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ফারসির প্রভাব এমনই ছিল যে, স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান ছাড়া ইউরোপীয় বণিক কোম্পানির লোকেরাও এ ভাষা শিখত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েও এদেশে আসার আগে বৃটেনে সেমিনারি খুলে ফারসি শিখত। আঠারো শতকে বাংলার এরূপ ভাষা-পরিস্থিতি লক্ষ করে  হ্যালহেড তাঁর বাংলা ব্যাকরণে বলেন যে, বাংলা ক্রিয়ার সঙ্গে সর্বোচ্চ সংখ্যক আরবি-ফারসি বিশেষ্য মিশ্রিত করে যাঁরা কথা বলেন, তাঁরাই সুচারুরূপে বাংলা জানেন বলে গণ্য করা হয়। এ শতকের দলিল-দস্তাবেজে এরূপ ভাষারই প্রাধান্য। সুকুমার সেন একে হিন্দু-মুসলমানের ‘কাজের ভাষা’ বা ‘ব্যবহারিক বাংলা’ বলে অভিহিত করেছেন। ভারতচন্দ্র একেই ‘যাবনী মিশাল’ ভাষা বলেছেন। তিনি আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি মিশ্রিত এরূপ ভাষাই শিখেছিলেন। সরস ও প্রসাদগুণসম্পন্ন না হলেও সবাই এ ভাষা বুঝত বলে তিনি দাবি করেছেন। উল্লেখ্য যে, ভারতচন্দ্র ও গরীবুল্লাহ একই অঞ্চলের (ভুরশুট পরগনার) অধিবাসী ছিলেন। তাঁদের আবির্ভাবকালও প্রায় সমসাময়িক। সুতরাং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এক শ্রেণীর বাঙালির কথ্যভাষাই পুথি সাহিত্যের ভাষার উৎস ছিল। একে কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা বলা যাবে না। আরবি-ফারসির মিশ্রণ থাকার কারণে সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানের কাছে এ ভাষা ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়।
বিষয় ও রস বিচারে পুথি সাহিত্যকে ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়: ১. রোম্যান্টিক প্রণয়কাব্য, ২. জঙ্গনামা বা যুদ্ধকাব্য, ৩. নবী-আউলিয়ার জীবনীকাব্য, ৪. লৌকিক পীর পাঁচালি, ৫. ইসলামের ইতিহাস, ধর্ম, রীতিনীতি বিষয়ক শাস্ত্রকাব্য এবং ৬. সমকালের ঘটনাশ্রিত কাব্য। ইউসুফ-জুলেখা,  লায়লী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল,  গুলে বকাওলী, বেনজির-বদরে মুনীর প্রভৃতি কাব্য প্রথম শ্রেণীর রচনা। এগুলিতে আরব-ইরান-ভারতের পৌরাণিক ও কাল্পনিক আখ্যান অবলম্বনে নরনারীর প্রেমের বিবরণ আছে। আমীর হামজা, সোনাভান, জৈগুনের পুথি, হাতেম তাই প্রভৃতি দ্বিতীয় শ্রেণীর কাব্য। এগুলিতে আরব-ইরানের ইসলামপূর্ব ও ইসলামউত্তর যুগের বীর পুরুষদের যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যজয় ও  ইসলাম প্রচারের বর্ণাঢ্য বিবরণ আছে। ঐতিহাসিক নবী, পীর, আউলিয়ার জীবনকথা, চরিত্র-মাহাত্ম্য ও ধর্ম-প্রচার নিয়ে তৃতীয় শ্রেণীর কাব্য রচিত হয়েছে। কাসাসুল আম্বিয়া, তাজকিরাতুল আউলিয়া, হাজার মসলা প্রভৃতি কাব্য এর অস্তর্ভুক্ত। হিন্দু দেবদেবীর সঙ্গে কাল্পনিক মুসলমান পীর-ফকিরের বিরোধ, যুদ্ধ এবং পরিণামে মিলন ও প্রতিষ্ঠা লাভের কাহিনী বর্ণনা করে চতুর্থ শ্রেণীর কাব্য রচিত হয়েছে, যেমন সত্যপীরের পাঁচালি, গাজীকালু চম্পাবতী, বনবিবির জহুরনামা, লালমোনের কেচ্ছা প্রভৃতি। পঞ্চম শ্রেণীর কাব্যভুক্ত নসিহতনামা, ফজিলতে দরুদ ইত্যাদিতে ইসলামের আচরণবিধি ও নীতি-উপদেশ বর্ণিত হয়েছে। সমকালের হাজী শরিয়তুল্লাহর মতো চরিত্র এবং ওহাবী-ফরায়েজীর মতো ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে স্বল্প সংখ্যক হলেও কিছু কাব্য রচিত হয়েছে। এগুলি ষষ্ঠ শ্রেণীর কাব্যের অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ্য যে, এ সবের অধিকাংশ বিষয় নিয়ে মধ্যযুগে মুসলমান কবিরা খাঁটি বাংলায় উচ্চ মানের কাব্যও রচনা করেছেন। ব্যতিক্রম ছাড়া পুথি সাহিত্যের কোনো রচনাই মৌলিক নয়; কবিরা ফারসি, উর্দু ও হিন্দি ভাষার গ্রন্থ উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁরা অনুবাদের সময় কেবল বিষয়ের অনুকরণ করেননি মূলের বহু শব্দ, বাক্যাংশ, এমনকি বাক্রীতিও অনুসরণ করেছেন। কোম্পানি আমলে বাংলার মুসলমানগণ পরাজিত জাতি হিসেবে পীড়ন ও বঞ্চনার শিকার হয়ে গভীর হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত হয়। এ অবস্থায় শায়ের কবিদের রচিত ইসলামের অতীত গৌরব, শৌর্যবীর্য, মহত্ত্ব ও ঐশ্বর্যের কাহিনী জাতির মনে আশ্বাস, আনন্দ ও সান্ত্বনা যোগায়। এজন্য দেখা যায়, অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে পুথি সাহিত্য উৎসভূমি অতিক্রম করে বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি পার্শ্ববর্তী উড়িষ্যা ও ত্রিপুরা রাজ্যের সাহিত্যেও এর প্রভাব পড়ে।
এ ধারায় কতজন কবি কী পরিমাণ কাব্য রচনা করেছিলেন, তার প্রকৃত জরিপ আজও হয়নি। জেমস লং এ ডেসক্রিপ্টিভ ক্যাটালগ অব বেঙ্গলি ওয়ার্কস্ (১৮৫৫) গ্রন্থে ৪১টি দোভাষী পুথির তালিকা দিয়েছেন।  মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা (১৯৬৪) গ্রন্থে ২৭০টি দোভাষী পুথির তালিকা দিয়েছেন, কিন্তু রচয়িতাদের নাম উল্লেখ করেননি। অধ্যাপক  আহমদ শরীফ সম্পাদিত ও  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত পুথি-পরিচিতি (১৯৫৮) গ্রন্থে শতাধিক কবির প্রায় ২০০ পুথির তালিকা আছে। অধ্যাপক আলী আহমদকৃত মুদ্রিত কলমী পুথির তালিকায় পুথিকারের নামসহ ৫৬৯ খানি কাব্যের নাম আছে। এসব উৎস থেকে পুনরাবৃত্তি বাদ দিয়ে শতাধিক কবির প্রায় দু-আড়াইশ কাব্যের নাম পাওয়া যায়। এ কাব্যগুলির বস্ত্তধর্ম ও কাব্যধর্ম কম হলেও বিষয়বৈচিত্র্য আকর্ষণীয়।
পুথি সাহিত্যের গ্রন্থগুলির মধ্যে আমীর হামজা, শাহনামা, আলেফ লায়লা, হাতেম তাই, তাজকিরাতুল আউলিয়া, কাসাসুল আম্বিয়া প্রভৃতি বিশাল আকৃতির। একাধিক সংস্করণ থেকে বোঝা যায়, কাব্যগুলির জনপ্রিয়তা ছিল। জালালাতল ফোক্রে নামক একটি কাব্যে শরিয়তপন্থী কর্তৃক  বাউল সম্প্রদায়ের বিরোধিতার বর্ণনা আছে। তবে সমকালের বিষয় নিয়ে রচিত এরূপ কাব্যের সংখ্যা খুবই কম। অতীতের ইতিহাস,  পুরাণ ও ঐতিহ্য মিশ্রিত কল্পকাহিনীর সংখ্যাই বেশি। হানিফা, হামজা, হাতেম তাই, সোহরাব-রুস্তম, জৈগুন বিবি প্রমুখ বীর চরিত্র নিয়ে রচিত কাব্যগুলি বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। ঐতিহাসিক ও কাল্পনিক অলি-আউলিয়া, পীর-মুর্শিদের অলৌকিক কীর্তিকলাপ নিয়ে রচিত কাব্যও জনপ্রিয় হয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল ইসলামের ঐতিহ্যের মধ্যে মুসলমানের পরাজিত মানসিকতার আশ্রয় লাভ। মুসলমানের বীরত্ব, ইসলাম প্রচার, কাফের নিধন ইত্যাদির বর্ণনা পড়ে বা শুনে তারা আত্মতৃপ্তি লাভ করত। উনিশ শতকে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের হাতে  বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল, তার সঙ্গে কোনো যোগসূত্র না রেখে সম্পূর্ণ বিপরীত স্রোতে অবস্থান নিয়ে শায়ের কবিগণ স্বসম্প্রদায়ের মানুষকে বাস্তবতাবিরোধী ও ইহলোকবিমুখ করে একটি স্বপ্নচারী ও কল্পনাবিলাসী জাতিতে পরিণত করে। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পন্ডিতদের হাতে ‘পন্ডিতি বাংলা’ ও আধুনিক গদ্য প্রবর্তিত হলে হিন্দু লেখকগণ পূর্বের মিশ্র ভাষারীতি ত্যাগ করেন। আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানরাও এ ভাষা ত্যাগ করেন।  ইংরেজি, ফারসি ও বাংলা ভাষা সম্পর্কে কোম্পানির গৃহীত ভাষানীতি এরূপ পরিবর্তনকে আরো ত্বরান্বিত করে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এসব রূপান্তর না ঘটলে হয়তো পুথির বাংলাই সর্বসাধারণের ভাষারূপে গণ্য হতো। বাংলার এক শ্রেণীর মুসলমান যুগের পরিবর্তনকে উপেক্ষা করে উনিশ শতক অবধি যে ভাষা ও সাহিত্যকে নিতান্ত মোহবশে অন্তরে লালন করেছেন, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছাড়া আজ আর কোনো মূল্য নেই। সৃজনশীলতা, মানবভাবনা ও কাব্যত্ব না থাকার কারণে এযুগের পাঠক তা পাঠও করে না। যুগের প্রয়োজনে যেভাবে কবিওয়ালা গানের উদ্ভব ও বিলয় ঘটেছিল, সেভাবে পুথি সাহিত্যেরও উদ্ভব ও বিলয় সাধিত হয়েছে। উভয় ধারা আঠারো-উনিশ শতকের অবক্ষয় ধারণ করে এখন সাহিত্যের ইতিহাসের উপাদানে পরিণত হয়েছে।  [ওয়াকিল আহমদ]
গ্রন্থপঞ্জি  সুকুমার সেন, ইসলামী বাংলা সাহিত্য, ২য় সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৭৩; মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা (৩য় খন্ড), ঢাকা, ১৯৬০-৬৬; Kazi Abdul Mannan, Emergence and Developement of Dobhasi Literature in Bengal, ঢাকা, ১৯৬৬; আনিসুজ্জামান, মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য, ঢাকা, ১৯৬৪।পুঁথি-সাহিত্য আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। এমন এক সময় ছিল যখন ঘরে ঘরে ছিল পুঁথি। দিনের আলো নিভে গেলেই কুপি জ্বালিয়ে শুরু হত পুঁথি-পাঠ। পুঁথি-পাঠককে ঘিরে সকলেই জড়ো হতেন এবং মনোযোগ সহকারে শুনতেন। প্রাচীনকালে মূলত প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষেরাই ছিল পুঁথি অনুরাগী। তাদের লেখাপড়া বা ভাবনা-চিন্তার পরিধি আটপৌরে হলেও অন্যরা যে একে অবহেলা করতো, তা কিন্তু নয়। সেকালে পুঁথি ছিল সার্বজনীন। শিশু-কিশোর-বয়স্ক নির্বিশেষে সকলের কাছেই পুঁথি-সাহিত্যের অনুপম কাহিনী-আখ্যানগুলো ছিল অমৃততুল্য। আধুনিক যন্ত্র-সভ্যতার দাপুটে বাস্তবতায় প্রাচীন পুঁথিকাব্য, পুঁথি-কাহিনী বিস্মৃত ও বিলুপ্ত প্রায় হলেও আজো মানুষ ফিরে যেতে চায় স্বপ্ন, কল্পনা ও বাস্তবতার মিশেলের সেই বিমূর্ত নান্দনিক স্টেশনে, যেখানে পুঁথি সাহিত্যের মিথ কল্পকথা, লোক কাহিনী, লোকাচার, ধর্মকথা, রাজবন্দনা, হাসিকান্না, যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গের রূপচ্ছটায় বিরাজ করে অলৌকিক আনন্দ ভুবন।
প্রাচীনকালে যখন ছাপাখানা ছিল না তখনো প্রচলন ছিল পুঁথির। এ উপমহাদেশে ত্রয়োদশ শতকের পূর্বে কাগজ ব্যবহারের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। (ওহফরধহ চধষবড়মৎধঢ়যু- ইঁযষবৎ, ১৯৬২, চধমব-১৪৫) । আর ১৭৭৮ সালের পূর্বে বাংলাভাষার কোন ছাপাখানাও এ তল্লাটে ছিল না। ১৭৭৮ সালে হুগলিতে প্রথম বাংলা ছাপাখানা স্থাপিত হয়। তবে এতদঞ্চলে এয়োদশ শতকের পূর্বে কাগজ ব্যবহারের নমুনা বা ১৭৭৮ সালের পূর্বে ছাপানো পা-ুলিপি আবিষ্কৃত না হলেও অন্যান্য উপাদানে যে লিখন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথিগুলো সাধারণত ভূর্জছাল, কাপড়ের পট, তালপাতায় লেখা হত। তালপাতার পুঁথিগুলোর বেশীর ভাগই ছিল পুজোর পুঁথি। মাদুলির মন্ত্রগুলো লেখা হতো ভূর্জছালে। মুসলমানদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ভিত্তিক বিভিন্ন পুঁথিও লিখিত হতো তালপাতায়। তেরেট নামে তাল জাতীয় এক প্রকার বৃক্ষের পাতায়ও তখন পুঁথি লেখা হতো। ‘কবি মুকুন্দ রামের বাসভূমি দামুন্যায় তেরেট পাতায় লেখা ‘চ-ী-মঙ্গলের’ একটি পুঁথি সংরক্ষিত আছে’। (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস- প্রথম খ--সুকুমার সেন। চতুর্থ সংস্করণ-১৯৬৩। কোলকাতা। পৃঃ ৫১৪)। তবে ‘হরিতালী কাগজ’ নামে পরিচিত তুলট কাগজে লেখা পুঁথি তখন ব্যাপক সমাদৃত ছিল। কাব্য-সাহিত্য-ধর্মী পুঁথিগুলো এ ধরনের তুলট কাগজে লেখা হতো। এ কাগজ যত মজবুত হতো, লেখাও তত সুন্দর দেখাত। ছাপাখানার ব্যাপক প্রসারের ফলে ঊনবিংশ শতকে পুঁথি-সাহিত্যের নব উন্মেষ ঘটে। এ সময় থেকে হস্তলিখিত পা-ুলিপি বা পুঁথির ব্যবহার ক্রমে লোপ পেতে থাকে এবং এর জায়গা দখল করে নেয় মুদ্রিত পুঁথি। এসময় কোলকাতার শোভাবাজার কেন্দ্রিক বিশেষ ধরনের পুঁথি বা বটতলার পুঁথির প্রচলনের ফলে ‘পুঁথি’ শব্দটি বিভ্রান্তির শিকার হয়।
পুঁথি সাধারণত দু’ধরনের-১) কবির হস্তলিখিত মূল রচনা (ঙৎরমরহধষ গধহঁংপৎরঢ়ঃ) ও ২) লিপিকারের অনুলিপি (ঈড়ঢ়রবফ গধহঁংপৎরঢ়ঃ) । প্রথম ধরনের পুঁথি এখন আর পাওয়া যায় না। লিপিকারের অনুলিপি নিয়েই আমাদের পুঁথির জগৎ- যা থেকে বটতলার পুঁথি বা ছাপানো পুঁথির উদ্ভব। পুঁথির বিষয়বস্তু নানা ধরনের হতে পারে-যেমন কাব্যসাহিত্য, চরিতকাব্য, মহাকাব্য, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদ সাহিত্য, ধর্মকথা, জঙ্গনামা, নবী কাহিনী, দেব-দেবী-পীর আউলিয়া বন্দনা, তন্ত্রমন্ত্র, পূজাবিধি, রাজবন্দনা, পাঁচালি, পদাবলী ইত্যাদি।
বলা হয়ে থাকে, ‘পুঁথি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পুস্তক’ থেকে। তবে প্রাকৃত ‘পুত্থিয়া’, হিন্দি ‘পোথী’, অসমীয়া ‘পুথী’, ফরাসী ‘পুস্তিন’ও যে বাংলা ‘পুঁথি’ বা ‘পুঁথি’ শব্দের প্রচলনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেনি তা বলা যাবে না। প্রাচীন হস্তলিখিত পুঁথি যদিও লিখিত সাহিত্য, তথাপি এর প্রস্তুতিকর্মের প্রতিটি পর্যায়ে লোকায়ত উদ্যোগ দৃষ্টিগ্রাহ্য হতো। পুঁথির ভেতরের প্রতিটি পাতা চারদিকে মার্জিন রেখে সাজানো হতো, যাতে পৃষ্ঠা ওল্টানো মাত্রই লেখাগুলো দৃশ্যমান হয়। পাতায় কোন লাইন না টেনে সমান্তরালভাবে প্রতি পাতায় সম-সংখ্যক ছত্র সন্নিবেশ করে নিপুণ পটুয়ার মতো পুঁথি যেভাবে লিপিবদ্ধ হতো, তা আজো আমাদের বিস্ময়ে হতবাক করে। প্রাচীন পুঁথিতে উভয় পৃষ্ঠায় লেখার রেওয়াজ ছিল। তবে কাগজ খুব পাতলা হলে উভয় পৃষ্ঠায় না লিখে কাগজ দুভাঁজ করে উভয় পাশে লিখা হতো। পুঁথির পত্রাঙ্ক প্রতি পৃষ্ঠায় না লিখে সাধারণত পাতার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখা হত। আবার এমন পুঁথিও দেখা গেছে, যেগুলোতে লিপিকার পত্রাঙ্ক নির্দেশ করত না। পুঁথির দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন, অলঙ্করণ, ভুল-ত্রুটি সংশোধন ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানা চিহ্নের প্রয়োগ হত। প্রাচীন পুঁথির পাতাগুলো ধারাবাহিকভাবে একের এক সাজানো, আলগা ও সেলাইবিহীন ছিল বিধায়, সেগুলোকে কাঠের পাটা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হত। এক্ষেত্রে শাল বা সেগুন কাঠের পাটা ব্যবহত হত। এছাড়া কোন কোন পুঁথির বহিরাবরণ হিসেবে চামড়ার খোলের ব্যবহারও চোখে পড়ত। এসব কাঠের পাটা বা চামড়ার আবরণে বাইরের দিকে পুঁথির বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত নানা নকশা বা চিত্র খোদাই বা অঙ্কিত করা হতো। ভেতরের দিকে থাকতো নানা লতা-পাতার চিত্র। ধারণা করা হয়, সতের শতকের লোক-শিল্পের প্রভাব এসব চিত্রে পরিস্ফুট। (অ এবহবৎধষ এঁরফব ঃড় উধপপধ গঁংবঁস, উযধশধ, ১৯৬৪ চধমব-৪৮) ।
প্রাচীনকালে লিখিত বাংলা পুঁথিগুলোর বেশীর ভাগই ছিল বাংলা হরফে। তবে কিছু কিছু বাংলা পুঁথি আরবী হরফেও লিখিত পাওয়া গেছে। যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘বাংলা পুঁথির তালিকা সমন্বয়’ গ্রন্থে এ ধরনের আরবী হরফে লিখিত বাংলা পুঁথির নমুনা খুঁজে পাওয়া যায়। (বাংলা পুঁথির তালিকা সমন্বয় (১ম খ-)-যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য। ১৯৭৮ইং। পৃষ্ঠা-৩৮১।) উড়িষ্যা রাজ প্রদর্শনশালা ‘ভুবনেশ্বরে’ ওড়িয়া অক্ষরে অনেক বাংলা পুঁথি সংরক্ষণ করা আছে (প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা-৩৮১)। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সংগ্রহে বাংলা অক্ষরে একটি উর্দু পুঁথির নমুনা পাওয়া গেছে। (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুঁথি-ক্রমিক-৫৮, পৃঃ ১৭৯, পত্র -৯১-১১৫)। কাইথি লিপিতে লেখা ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল’ এর দুটি কপি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পুঁথিশালায় সংগৃহীত আছে। আঠারো-উনিশ শতকে সিলেট অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিকশিত ‘নাগরী লিপিতে’ প্রচুর পুঁথি লিখিত হয়েছে। নাগরী লিপিতে পুঁথি লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন-শীতালং শাহ্, আরকুম শাহ্, শাহনুর শাহ্, ইরফান আলী, ভেলা শাহ্, মুহাম্মদ খলিল, আবদুল কাদির শাহ্, ওয়াহেদ আলী শাহ্, আছদ আলী, মুন্সী সাদেক আলী, মুন্সী আবদুল করিম, ছৈয়দুর রহমান, শাহ আরমান আলী, দীন ভবানন্দ প্রমুখ।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের সেতুবন্ধন হচ্ছে পুঁথি। একারণে সুদূর অতীত থেকেই পুঁথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা দৃষ্ট হয়। এদেশে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রথম পুঁথি সংগ্রহে হাত দেন কয়েকজন বৃটিশ নাগরিক। তাদের মধ্যে বাংলা ব্যাকরণের আদি রচয়িতা নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০) অন্যতম। তিনি ১৭৭২ থেকে ১৭৮৩ সালে বাংলাদেশে অবস্থানকালে ১২টি বাংলা পুঁথি সংগ্রহ করেন, যা পরে তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অর্থের বিনিময়ে প্রদান করেন। এর মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত, চ-ীমঙ্গল ও কালিকামঙ্গল উল্লেখযোগ্য। হ্যালহেডের ব্যাকরণের বাংলা হরফ নির্মাতা চার্লস উইলকিন্স ১৭৮৬ সালের দিকে ‘চ-ীমঙ্গল’ ও ‘বিদ্যাসুন্দর’ নামে দুটি পুঁথি সংগ্রহ করে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে প্রদান করেন। বৃটিশ গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিচার্ড জনসন ১৮০৭ সালে এদেশ থেকে সংগৃহীত ১৪টি বাংলা পুঁথি ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরীতে প্রদান করেন। তার পুঁথিগুলোর মধ্যে রয়েছে কাশীরাম দাশের ‘মহাভারত’ লোচন দাশের ‘দুল্লভসার’ ‘চৈতন্যতত্ত্বসার’ ও ‘নামসংকীর্ত্তন’। ১৭৯৩ সালের নভেম্বর বঙ্গদেশে আসেন উইলিয়াম কেরী (১৭৬১-১৮৩৪)। তাঁর নেতৃত্বে ১৮১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজ গ্রন্থাগার (কেরী লাইব্রেরী) এ খ্রীষ্টান মিশনারীগণ ৩ হাজারেরও বেশী বই ও হস্তলিখিত পুঁথি দান করেন। সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ১৯২১ সালে সংগৃহীত পুস্তক তালিকায় আমরা ৫১টি বাংলা পুঁথির নাম পাই। (বাংলার নব জাগরণে উইলিয়াম কেরী ও তার পরিজন-সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায়। ১৯৭৪ইং, পৃঃ ১৬৭)। সে সংগ্রহে ছিল ‘মনসার ভাসান’, ‘চ-ী’, ‘জৈমুনী ভারত’, ‘চৈতন্য মঙ্গল’, ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ পুঁথি। এদেশে সরকারী প্রচেষ্টায় ১৯৬৮ সালে প্রথম পুঁথি সংগ্রহের উদ্যোগ নেয় এশিয়াটিক সোসাইটি। বৃটিশ গভর্ণর জেনারেল লর্ড লরেন্সের অনুদানকৃত ৩২০০/- টাকা দিয়ে শুরু করা এ কাজে প্রথম দায়িত্ব দেয়া হয় পুরাতত্ত্ববিদ রাজেন্দ্র লাল মিত্র ও পরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে। রাজেন্দ্র এ কাজে ততটা সফল না হলেও হরপ্রশাদ শাস্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় অনেক দুষ্প্রাপ্য বাংলা পুঁথি সংগৃহীত হয়। ১৯৪১ সালে প্রকাশিত এশিয়াটিক সোসাইটির ‘পুঁথি বিবরণী’তে এ ধরনের ৩৬৭টি পুঁথির বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। নগেন্দ্র নাথ বসু প্রায় ৩০০০ (তিন হাজার), সনৎকুমার বসু ২০০০ (দুই হাজার) এবং হরিদাস পালিত অনেক পুঁথি সংগ্রহ করে ‘কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথিশালায় দান করলেও এসবের মধ্যে বাংলা পুঁথির সংখ্যা ছিল নিতান্ত নগণ্য। তবে মনীন্দ্র মোহন বসু সম্পাদিত ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংগৃহীত পুঁথি তালিকায়’ (১ম ও ২য় খ-, ১৯৪১ ও ১৯৬৩) মোট ৫৯২৭টি বাংলা পুঁথির বিবরণ আছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিশ্বভারতী’ বিভিন্ন ভাষার পুঁথি সংগ্রহের কাজ করে। ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ের এক হিসাবে দেখা যায়, এ সময় পর্যন্ত বিশ্বভারতীতে ১৪৩৯টি বাংলা পুঁথি ছিল্ চট্টগ্রামের আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ আজীবন পুঁথি সংগ্রহ করেন। তিনি প্রায় সহস্রাধিক পুঁথি আবিষ্কার করেছেন এবং এসব পুঁথি অসাধারণ দক্ষতার সাথে সম্পাদনা করেছেন। তার আবিষ্কৃত পুঁথি নিয়ে তিনি প্রায় ৬ শতাধিক প্রবন্ধ লিখে প্রাচীন ও মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্য বিষয়ে পাঠকদের অবহিত করেন। তার সংগৃহীত পুঁথির মধ্যে আছে আবদুন নবীর ‘আমীর হামজা’ (রচনা-১৮৫৯) শাহ মোহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলেখা’ (রচনা-১৭৩২), সৈয়দ সুলতানের ‘ওফাত-ই-রসুল’ (লিপিকাল-১৮৩৯), মোহাম্মদ খানের ‘কেয়ামত নামা’, শেখ ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষবিজয়’ (১৭৭৭), আলী রেজা ওরফে কানু ফকিরের ‘জ্ঞান সাগর’, আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ (লিপিকাল-১৮৭৮), মোহাম্মদ খানের ‘মুক্তল হোসেন’ (লিপি-১৭৭৪), মোহাম্মদ হানিফার লড়াই (১৭২৪), দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লায়লী মজনু’ (১৮২৯), দৌলত কাজীর ‘সতীময়না-লোর চন্দ্রানী’, (লিপি-১৭৫৪), ফকির গরীবুল্লাহর ‘সোনাভান’ ইত্যাদি। তার সংগৃহীত ৫৮৫টি মুসলিম বাংলা পুঁথি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেছেন। তার সংগৃহীত ৩৩৮টি পুঁথি রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। মধ্যযুগের সাহিত্য গবেষক ড. এনামুল হক গবেষণার প্রয়োজনে কিছু পুঁথি সংগ্রহ করেন। তার সংগৃহীত ২৩টি বাংলা পুঁথি বরেন্দ্র রিসার্চ যাদুঘরে আছে। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির প্রতিষ্ঠাতা শরৎ কুমার রায় সংগৃহীত ১১১০টি পুঁথিও এ মিউজিয়াম গ্রন্থাগারে রয়েছে। অধ্যাপক মনসুর উদ্দিনের সংগ্রহে কিছু পুঁথি ছিল।্ চট্টগ্রামে ইসহাক চৌধুরীর ব্যক্তিগত সংগ্রহেও অনেক পুঁথি রয়েছে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেও অনেক পুঁথির সংগ্রহ আছে। ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘পরিষৎ পরিচয়’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এ সময় পরিষদ পুঁথিশালায় সংরক্ষিত বাংলা পুঁথির সংখ্যা ছিল ৩২৪৬টি(পরিষৎ পরিচয়- ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৩৫৬। পৃঃ-৩০)। শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদে ৪৭৯টি বাংলা পুঁথি সংগৃহীত ছিল বলে যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য প্রকাশিত একটি তালিকা থেকে জানা যায়। (বাংলা পুঁথির তালিকা সমন্বয় (১ম খ-)- অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য, এশিয়াটিক সোসাইটি, কোলকাতা, ১৯৭৮)। ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পুঁথি সংগ্রহ সমিতি’ গঠিত হলে ঢাকা যাদুুঘরের কিউরেটর নলিনীকান্ত ভট্টাশালীকে এর সম্পাদক নিয়োগ করা হয়। তার নেতৃত্বে প্রায় ১৭,০০০ বাংলা ও সংস্কৃত পুঁথি সংগৃহীত হয়। এর কিছু পুঁথি বাংলাদেশের জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক পুঁথি সংরক্ষিত আছে। বাংলা একাডেমীও কিছু পুঁথি সংগ্রহ করেছে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী এ সংখ্যা ৩৪৪১টি।
প্রাচীন পুঁথি ভূর্জপত্র, তালপাতা, তেরেট পাতা, হরিতালী কাগজ ইত্যাদি ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী উপাদানে লেখা হতো বলে স্যাঁতসেঁতে বিরুপ আবহাওয়ায় তা নষ্ট হয়ে যেত। তা সত্ত্বে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যে সব পুঁথি আজো টিকে আছে তা আমাদের বাংলা সাহিত্যের মহামূল্যবান সম্পদ। প্রাচীন পুঁথি তা খ-িত, পূর্ণাঙ্গ কিংবা একটি মাত্র পাতা- যাই হোক না কেন এর ঐতিহাসিক মূল্য কম নয়। এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আমাদের বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় ঐতিহ্য। ‘চর্যাপদ’ ও ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ এর কথা আমরা কে না জানি! অথচ এ দুটি পুঁথিও খ-িত ও বিচ্ছিন্ন। আর এগুলো আবিষ্কারের পরই আমাদের নজরে আসে, প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অনেক অনাহরিত অধ্যয়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে নেপালের রাজদরবার থেকে ৪৬টি চর্যাপদ তথা বৌদ্ধ গান ও দোহা উদ্ধার করেন, যা বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। চর্যাপদের ভাষা দুর্বোধ্য হলেও এগুলো যে বাংলা গীতিকাব্য তথা বাংলা পুঁথির আদিরূপ- তাতে সন্দেহ নেই। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের পুঁথি উদ্ধারের ফলে মধ্যযুগের কীর্তনধারার সুস্পষ্ট রূপ আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।’ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর একমাত্র পুঁথিটি কোলকাতার ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পুঁথিশালায়’ সংরক্ষিত আছে।
আনুমানিক পঞ্চদশ শতকে লিখিত এই পুঁথিটি বাংলা লিপির প্রাচীনতম নির্দশন। দৌলত কাজীর ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’, আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ মধ্যযুগের কাব্য সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বস্থানীয় ‘পুঁথি’। মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ বলেন, ‘নর-নারীর প্রণয়কে উপলক্ষ করে মধ্যযুগে যে আখ্যায়িকা-কাব্য গড়ে উঠেছিল, তাকে ‘রোমান্স কাহিনী কাব্য’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’ এই ধারারই শ্রেষ্ঠ কাব্য’ (সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী-সম্পাদনায়-মযহারুল ইসলাম ও মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ। নওরোজ কিতাবিস্থান, ঢাকা-১৯৭৩, পৃঃ-৩৬) আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ সম্পর্কে ক্ষেত্রগুপ্ত বলেন, ‘পদ্মাবতী কাব্যকে মাঝে মাঝে মাধ্যযুগের বাংলা কাব্যের বাতায়ন নামে চিহ্নিত করার বাসনা জাগে, (প্রাচীন কাব্য সৌন্দর্য জিজ্ঞাসা ও নব মূল্যায়ন- ক্ষেত্র গুপ্ত।
পুস্তক বিপণি, কোলকাতা। পৃঃ-১৭৮)। এ ধরনের অসংখ্য পুঁথি আজো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদেশের পথে-প্রান্তরে। অতীত বর্তমানের সেতু-বন্ধনের প্রয়োজনে, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎসমুখের খোঁজে, আমাদের শিকড়ের সন্ধানে ধূলিমলিন আস্তরণ থেকে এসব খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে এসব পুঁথির সংরক্ষণ, আরো পুঁথি সংগ্রহ এবং পুঁথির ব্যাপক চর্চা ও গবেষণা প্রয়োজন।
প্রকাশিত : ১৪ জুলাই ২০১৬
- See more at: http://www.dailyjanakantha.com/details/article/203574/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%80%E0%A6%A8-%E0%A6%AA%E0%A7%81%E0%A6%81%E0%A6%A5%E0%A6%BF-%E0%A6%89%E0%A7%8E%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%96%E0%A7%87%E0%A6%BE%E0%A6%81%E0%A6%9C%E0%A7%87#sthash.48tvACFa.dpuf

পুঁথি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
Jump to navigationJump to search
সংস্কৃত শব্দ 'পুস্তিকা' শব্দ থেকে পুথি শব্দটির উৎপত্তি। এর নাসিক্য উচ্চারণ পুঁথি। হাতে লেখা বইকে আগে 'পুস্তিকা' বলা হতো। যেহেতু আগের দিনে ছাপাখানা ছিল না, তাই তখন হাতে পুঁথি লেখা হতো। প্রাচীন বা মধ্যযুগের প্রায় সকল সাহিত্য হাতে লিখতে হয়েছিল এবং এদের একাধিক সংস্করণও তৈরি হয়েছিল হাতে লিখে। তাই প্রাচীন ও মধ্যযুগের সকল সাহিত্যকেই পুঁথিসাহিত্য বলা হয়।

উল্লেখযোগ্য পুঁথিসাহিত্য[সম্পাদনা]

সাততেতৈয়া

শরিয়ত,তরিকত,হাকিকত ও মারফত কাকে বলে? বিস্তারিত?

পবিত্র কুরআন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান।

হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-বড় পীর এর জীবনী

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

তাজবীদ

জামে মসজিদ নীতিমালা